DEV Community

Cover image for জাকাতের বিধান ও নিয়ম-কানুন: সম্পদের পবিত্রতা ও সামাজিক ন্যায়ের পথ
RONiB
RONiB

Posted on • Edited on

জাকাতের বিধান ও নিয়ম-কানুন: সম্পদের পবিত্রতা ও সামাজিক ন্যায়ের পথ

জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি কেবল একটি ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার এবং দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের একটি উপায়। জাকাত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো "পবিত্রতা" এবং "বৃদ্ধি"। এর মাধ্যমে একজন মুসলিম নিজের সম্পদকে পবিত্র করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। এই আর্টিকেলে আমরা জাকাতের নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান, এর গুরুত্ব, প্রকারভেদ, এবং সঠিকভাবে প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

জাকাত কী?

জাকাত হলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ, যা ধনী মুসলিমদের তাদের সম্পদের একটি অংশ নির্দিষ্ট শর্ত পূরণের পর দরিদ্র ও অভাবীদের মাঝে বিতরণ করতে হয়। কুরআনে জাকাতের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেন,

"তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও।" (সূরা বাকারা, আয়াত: ৪৩)

জাকাত প্রদানের মাধ্যমে একজন মুসলিম তার সম্পদের প্রতি লোভ ত্যাগ করে এবং সমাজের দরিদ্রদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। এটি সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত

জাকাত প্রদান ফরজ হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলো হলো:

  1. মুসলিম হওয়া: জাকাত শুধুমাত্র মুসলিমদের উপর ফরজ। অমুসলিমদের উপর জাকাত ফরজ নয়।
  2. প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া: অপ্রাপ্তবয়স্ক বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির উপর জাকাত ফরজ নয়।
  3. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা: নিসাব হলো সম্পদের সেই ন্যূনতম পরিমাণ, যার উপর জাকাত ফরজ হয়। এটি সাধারণত ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ বা ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্যের সমপরিমাণ সম্পদ।
  4. এক বছর অতিবাহিত হওয়া: সম্পদ নিসাব পরিমাণে পৌঁছানোর পর একটি পূর্ণ হিজরি বছর অতিবাহিত হতে হবে।
  5. সম্পদের মালিকানা: সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। ধার বা ঋণের সম্পদের উপর জাকাত ফরজ নয়।
  6. অতিরিক্ত সম্পদ: জাকাত শুদ্ধমাত্র অতিরিক্ত সম্পদের উপর প্রযোজ্য, যা ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা (যেমন, খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক) পূরণের পর অবশিষ্ট থাকে।

জাকাতযোগ্য সম্পদ

জাকাত বিভিন্ন ধরনের সম্পদের উপর প্রযোজ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  1. নগদ অর্থ ও ব্যাংক সঞ্চয়: ব্যাংকে বা হাতে থাকা নগদ অর্থের উপর জাকাত প্রযোজ্য।
  2. স্বর্ণ ও রৌপ্য: গহনা, মুদ্রা বা অন্যান্য আকারে থাকা වা স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর জাকাত ফরজ।
  3. ব্যবসায়িক সম্পদ: ব্যবসায়ের পণ্য, যা বিক্রির জন্য রাখা হয়, তার উপর জাকাত দিতে হয়।
  4. কৃষি উৎপাদন: ফসলের উপর জাকাত প্রযোজ্য, যা নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছায়।
  5. পশুসম্পদ: গবাদি পশু, যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির উপর জাকাত ফরজ।
  6. খনিজ সম্পদ: খনি থেকে উত্তোলিত সম্পদের উপর জাকাত প্রযোজ্য।

জাকাতের হার

জাকাতের হার সম্পদের ধরনের উপর নির্ভর করে। সাধারণত:

  • নগদ অর্থ, স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্যবসায়িক সম্পদ: ২.৫% (অর্থাৎ ১০০ টাকার মধ্যে ২.৫ টাকা)।
  • কৃষি উৎপাদন: সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে ৫%, এবং বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে ১০%।
  • পশুসম্পদ: পশুর সংখ্যা ও প্রকারভেদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে জাকাত দিতে হয়।

জাকাত কাদের দেওয়া যায়?

কুরআনে জাকাতের খাত বা প্রাপকদের স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, জাকাত প্রদান করা যায়:

  1. ফকির: যাদের কোনো সম্পদ নেই এবং জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন।
  2. মিসকিন: যারা দারিদ্র্যের মধ্যে আছে কিন্তু সাহায্য চায় না।
  3. জাকাত সংগ্রহকারী: যারা জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত।
  4. নওমুসলিম: যারা সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তাদের ঈমান মজবুত করার জন্য।
  5. দাসমুক্তি: দাস বা ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য।
  6. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যারা ঋণের বোঝায় জর্জরিত এবং তা পরিশোধ করতে অক্ষম।
  7. আল্লাহর পথে: জিহাদ বা ইসলাম প্রচারের কাজে।
  8. মুসাফির: যারা ভ্রমণে অর্থের অভাবে বিপদে পড়েছে।

জাকাত প্রদানের নিয়ম

জাকাত সঠিকভাবে প্রদানের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়:

  1. নিয়ত: জাকাত প্রদানের সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করতে হবে।
  2. সঠিক হিসাব: সম্পদের সঠিক হিসাব করে নিসাব ও জাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
  3. সময়মতো প্রদান: জাকাত একটি হিজরি বছর পূর্ণ হওয়ার পর পরই প্রদান করতে হবে।
  4. স্থানীয় প্রাপকদের অগ্রাধিকার: স্থানীয় দরিদ্র ও অভাবীদের প্রথমে জাকাত দেওয়া উচিত।
  5. প্রকাশ্যে বা গোপনে: জাকাত প্রকাশ্যে বা গোপনে দেওয়া যায়, তবে গোপনে দেওয়া উত্তম।

জাকাতের গুরুত্ব ও উপকারিতা

জাকাতের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর কিছু উপকারিতা হলো:

  • আধ্যাত্মিক পবিত্রতা: জাকাত মানুষকে লোভ ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে।
  • সামাজিক সাম্য: জাকাত ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।
  • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: জাকাত সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে।
  • আল্লাহর নৈকট্য: জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।

জাকাত প্রদানে সতর্কতা

জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু ভুল এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন:

  • জাকাতের হিসাবে ভুল করা।
  • জাকাত প্রদানে বিলম্ব করা।
  • অযোগ্য ব্যক্তি বা খাতে জাকাত প্রদান করা।
  • জাকাতের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া।

জাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য স্তম্ভ, যা মুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম। এটি কেবল সম্পদের পবিত্রতা নিশ্চিত করে না, বরং সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক নিয়ম ও বিধান মেনে জাকাত প্রদান করলে একজন মুসলিম আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তাই প্রত্যেক সচ্ছল মুসলিমের উচিত জাকাতের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানা এবং তা যথাযথভাবে পালন করা।

Top comments (0)